কৃষি ক্ষেত্রে শরিয়াহ

WhatsApp
Telegram
Facebook
Twitter
LinkedIn

ক্যাম্পাসে একটি বড় বৃক্ষের নিচে তিন বান্ধবী মিলে গল্প করছে। এর মাঝে হঠাৎ  শুনতে পাচ্ছে মিষ্টি সুরে একটি মেয়ে বাবু খালা বাবু খালা বলে ডাকছে। তারা পেছনে তাকিয়ে দেখে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের মার্কেটিং এর বুদ্ধিমতী মেয়েটি যে কিনা সব সময়ই তাদের আশেপাশের সবাইকে মাতিয়ে রাখে। তার ডাক নাম হচ্ছে সুরমা। তখন তাদের মধ্যে একজন বলে ওঠে এই বাবু খালাটা আবার কে? তবে যাই হোক নামটা অনেক কিউট। আসলে এই বাবু খালাটা হচ্ছে তাদের তিনজনের একজন যে ব্যবস্থাপনা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী “জান্নাত”।

জান্নাত হচ্ছে সুরমার আম্মুর আদরের ছোট বোন অর্থাৎ সুরমার ছোট খালা যে কিনা সুরমার থেকে মাত্র তিন বছরের বড়। আর এই বাবু খালা নামটি এই বুদ্ধিমতী মেয়েটিরই আবিষ্কার যে কিনা ছোটবেলা থেকেই সবাইকে মাতিয়ে রাখে। 

তার মনের মাঝে সব সময় অদ্ভুত অদ্ভুত প্রশ্ন জাগে আর তার কথার মাঝে রয়েছে অসম্ভব রকমের যুক্তি। ছোটবেলায় তার এই যুক্তি এবং চোখের জলের কাছে সবাই অর্থাৎ তার নানা নানি, দাদা-দাদী, বাবা-মা, খালা-ফুপি প্রভৃতি হার মানতে বাধ্য। তার ছিল সবার কাছ থেকে আদর আদায় করে নেওয়ার অসম্ভব শক্তি। কিন্তু তার শাসনও ছিল খুব কঠোর। সবাই এই ছোট মেয়েটাকে যথেষ্ট ভয় পেতো। ছোটবেলায় যখন সবার নাম উচ্চারণ করতে পারত না তখন হয় তাদের নাম সংক্ষেপ করে দিত নাহয় উচ্চারণ সহজ করে দিত। এই যেমন তামান্নাকে তামা, তনিমাকে তন ইত্যাদি।

সুরমা ছোটবেলা থেকেই অনেক মিশুক স্বভাবের। তার বন্ধুর বয়স ছিল সমবয়সী থেকে শুরু করে তার নানা-নানী, দাদা-দাদি, এবং বাবা-মায়ের বয়সি। সে অনেক বাবা ভক্ত এবং তার বাবার কাছে সে রাজকুমারী। 

অপরদিকে আমাদের বাবু খালাও কোন অংশে কম নয়। বাবু খালা নামটা সবার কাছে এতটাই পছন্দের হয়ে পড়ে যে সে জাতীয় বাবু খালায় পরিণত হয়। অর্থাৎ তার বড় বোনেরা সহ অন্য যাদের সে খালা হয় না তারাও দুষ্টু করে বলে আমাদের বাবু খালা। 

বাবু খালার  রয়েছে অনেক সমবয়সী ভাগিনা ভাগ্নি। সবার চোখের মনি হচ্ছে আমাদের বাবু খালা। বাবু খালাকে না দেখলে তাদের কারোই ভালো লাগে না। সবাই তার সাথে গল্প করতে এবং খেলাধুলা করতে পছন্দ করে। তাছাড়া আমাদের বাবু খালা হচ্ছে অসম্ভব লিডারশিপ গুণাবলীর অধিকারী। সকল ধরনের সমস্যার সমাধানে এবং বিচারকার্যে সবাই তা শরণাপন্ন হয়। আলহামদুলিল্লাহ, সে জনবল এবং সম্পর্ক ব্যবস্থাপনায় অত্যন্ত নিপুন। 

সুরমা কাছে এসে চুপিচুপি বলে ছোটবেলার স্মৃতি খুব বেশি মনে পড়ছে। নানা বাড়ি যেতে চাই। জান্নাত মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে নানা বাড়ি বেড়াতে যাবা তাই বলে বাবু খালা বলে ক্যাম্পাসে চিৎকার করবা? 

আমি কি এখন আর বাবু খালা আছি? 

কিছুদিন পরে তো শ্বশুর বাড়ি চলে যেতে হবে। ঠিক আছে আগামী শুক্রবার আমরা তোমার নানাবাড়ি যশোর যাবো। আর কোন আবদার আছে তোমার?

আমার বাবু খালাটা অনেক ভালো এই বলে একটি দুষ্টু বাঁকা হাসি দিয়ে সুরমা সেখান থেকে বিদায় নিল। শুক্রবার সকাল বেলা সুরমা, বাবু খালাসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা মিলে যশোরের উদ্দেশ্যে রওনা শুরু করল। পদ্মা সেতু হওয়াতে এখন খুব সহজ এবং অনেক অল্প সময়ে যশোরসহ দক্ষিণ অঞ্চলের জেলা সমূহে যাওয়া যায়। মাত্র ২ ঘন্টা ৩০ মিনিটে ঢাকা থেকে ট্রেনে করে পদ্মা সেতু হয়ে সুরমা ও তার বাবু খালা যশোর পৌঁছল। তারা অসাধারণ ভ্রমণ অনুভব করল। কিন্তু গ্রামের বাড়িতে পৌঁছতেই তাদের আনন্দ মাটি হয়ে গেল। 

বাড়ির প্রবেশপথে শৈশবের স্মৃতিমাখা দুইটি খেজুর গাছ মারা গিয়েছে  এবং অনেকগুলো খেজুর গাছ মৃতপ্রায় অবস্থা।  শৈশবে এই খেজুর গাছের নিচে খেলা করত এবং শীতের সকালে পেট ভরে খেজুরের রস খেত।  সুরমা ও তার বাবু খালার চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি ঝরছে। তার নানু দূর থেকে এই অবস্থা দেখে দ্রুত তাদের কাছে আসে এবং কান্নার কারণ জানতে চায়। সুরমা বলে নানু খেজুর গাছগুলোর এই অবস্থা কি করে হলো?  

নানু বলে শুধু আমাদের বাড়ি নয় আশেপাশের অনেকের বাড়ির খেজুর গাছেরই একই অবস্থা। তারপর মন খারাপ নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে। পরের দিন ভোরে তারা শৈশবের মতো করে পেট ভরে খেজুরের রস পান করে। যথারীতি তারপরের দিন ভোরে তারা খেজুরের রস খাওয়ার জন্য বাড়ির উঠানে আসে কিন্তু আজ তাদেরকে কোন খেজুরের রস দেওয়া হলো না। 

সুরমা তার নানুর কাছে তাদের খেজুরের রস না দেওয়ার কারণ জানতে চায়। 

তার নানু বলে গত বছর শীতের শেষের দিকে জামাল মারা যায়।  তারপর থেকে ওর ছেলে তমাল গাছ কাটার কাজ করে। জামালের সময় প্রতিদিন সমান সমান খেজুরের রস ভাগ করে নেওয়া হত। বর্তমানে তার ছেলের নতুন নিয়ম বের করেছে একদিন তমাল নেয় আর একদিন আমাদের।  আর এতে নাকি ওর সুবিধা হয়। কি আর করার সুরমা আর বাবু খালা প্রতিদিন ভোরবেলা উঠে শৈশবের মতো করে খেজুরের রস নামাতে দেখে যা ওদের কাছে  অনেক ভালো লাগে। কিন্তু বর্তমানে ওরা একদিন খেজুরের রস খেতে পায় আর একদিন বিরতি থাকে। এইভাবে বেশ কিছুদিন যাওয়ার পর সুরমা আবিষ্কার করে যেদিন ওদের ভাগে খেজুরের রস পায় সেদিম তুলনামূলক কম হয় আর যেদিন তমালের ভাগে পড়ে সেদিন খেজুরের রস বেশি হয়। তাছাড়া তমালের ভাগের আগের দিন বিকালে গাছ কাটতেও তুলনামূলক সময় বেশি নেয়। বাবু খেলা বলে হ্যাঁ তাইতো আমার কাছেও এমনটা মনে হচ্ছে। 

সুরমা বলে তোমার কাছে মনে হচ্ছে আর আমি খুব সূক্ষ্মভাবে বিষয়টাকে পর্যবেক্ষণ করেছি। বাবু খালা বলে তা তো করবেই তা না হলে কি আমাদের বুদ্ধিমতী সুরমা।  বাবু খালা বলে আচ্ছা আমার এখন মনে পড়েছে তমালের কার্যক্রম তো শরিয়াহ নীতির বিপরীত। ওর বাবার কার্যক্রম ছিল শরীয়াহ সম্মত। এই নীতি অনুযায়ী আমাদের প্রতিদিনের খেজুরের রস ভাগ করে নেওয়ার কথা। মনে কর আমাদের জমি কোন ব্যক্তি চাষাবাদ করতে নিলো।  তার সাথে চুক্তি হলো এক বছর ফসল আমাদের দিবে আর এক বছর সে নিবে অথবা এক পাশের জমির ফসল আমাদের দিবে আর এক পাশের ফসল সে নেবে। এই চুক্তি শরিয়াহ সম্মত হবে না। শরিয়াহ নীতি হচ্ছে প্রতি মৌসুমে ফসল যা হবে তা দুইজন ভাগ করে নেওয়া মএতে অনেক ধরনের অপ্রত্যাশিত অবস্থা থেকে রক্ষা পাওয়ার পাশাপাশি অধিক পরিমাণে বারাকাহ পাওয়া যায়। সুরমা বলে  আচ্ছা তুমি আমাকে এটা আগে বলবে না। এই জন্যই তো আমাদের খেজুর গাছের এই অবস্থা। লোভী তমাল যেদিন ওর ভাগে খেজুরের রস পাওয়ার কথা তার আগের দিন বিকালে বেশি সময় নিয়ে বেশি নিয়ে গাছ কাটে ফলে পরের দিন বেশি পরিমাণে খেজুর রস হয়।

আর তার লোভের ফলস্বরূপ  দুই বছরেই আমাদেরসহ গ্রামের অন্যদেরও খেজুর গাছের এই অবস্থা। বাবু খালা বলে আমি তো এভাবে চিন্তা করি নাই। মাশাল্লাহ,  আমাদের সুরমাতো খুব সূক্ষ্ম চিন্তা করতে পারে। বাস্তব সত্য হচ্ছে ইসলামের শরিয়াহ নীতির মধ্যে রয়েছে দৃশ্যমান এবং অদৃশ্যমান বারাকাহ। সুরমা তার নানা নানুকে বিষয়টা বুঝিয়ে বলে তোমাদের খেজুর রস ভাগ করার পদ্ধতিটি পরিবর্তন করে পূর্বের মতো অর্থাৎ তমালের বাবার সময়ের মতো করো। এতে পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে গ্রামের খেজুর গাছের চেহারার ব্যাপক পরিবর্তন আসে। তাছাড়া ফসলের ভাগের পরিবর্তনের মাধ্যমেও জমির মালিক এবং চাষিরা উপকৃত হয়। আমাদের সমাজ এমন অনেক কার্যকলাপ আছে যা আমরা কখনো জেনে বা কখনো না জেনে ভুল করে থাকি। আর তমালের মত কতিপয় অসাধু ব্যক্তি সেই সুযোগ নিয়ে থাকে। তাই আমাদের জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি করা উচিত।

সম্পূর্ণ গল্পের বই খুব শিগগিরই আসিতেছে